BCS General Knowledge Bangladesh Affairs Lecture-1

লেকচার-০১

বিষয়ঃ বাংলার ইতিহাসের প্রাচীনযুগ।

 

ভূমিকা : প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রাচীন যুগের স্থিতিকাল ছিল। মানুষের বসতিস্থাপন থেকে শুরু করে সাত হাজার বছর পূর্বের সময়কালকে বলা হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগ। প্রাগৈতিহাসিক যুগকেই বলা হয় পাথরের যুগ। খৃষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে আলেকজান্ডার তার সেনাপতি সেলুকাসের নেতৃত্বে ভারতবর্ষ অভিযানে আসেন। এই অভিযানের পরে ভারতের ইতিহাস (লিখিত) এই লিখিত ইতিহাসের পূর্বে বা আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের পূর্বের ইতিহাস হলো প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাস।

(১) বাঙালি জাতির উদ্ভব ও পরিচিতি : বাঙালি জাতির উদ্ভব ও পরিচিতির দুটো দিক আছে। যথা :-

১(ক) ভাষা ও

১(খ) জনগোষ্ঠী।

.(ক) ভাষা : অধিকাংশ ভাষা বিজ্ঞানীদের অভিমতে বংশগত শ্রেণীতে বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার দুটি শাখা ছিল। এর মধ্যে বাংলা শতম (৩৫০০ খৃ: পূর্ব) শাখার একটি ভাষা। অপরটির নাম কেন্তম।

.(খ) জনগোষ্ঠী :

বর্তমান বাঙালি জনগোষ্ঠী বহুকাল ধরে নানা জাতের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:-

প্রাক-আর্য বা অনার্য জনগোষ্ঠী ও

আর্য জনগোষ্ঠী।

প্রাক-আর্য বা অনার্য জনগোষ্ঠী : এদেশে আর্যদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত অনার্যদেরই বসতি ছিল। এই প্রাক-আর্য জনগোষ্ঠী বাঙালি জীবনের মেরুদন্ড। বাংলার আদিম জনগোষ্ঠী অধিবাসী আর্যজাতি থেকে উদ্ভূত হয়নি। আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠী মূলত চারটি। যথা:-

(১) নেগ্রিটো

(২) অস্ট্রিক

(৩) দ্রাবিড় ও

(৪) ভোটচীনীয়/মঙ্গোলীয়।

১) নেগ্রিটো : নেগ্রিটোরা এদেশের প্রাচীন জনগোষ্ঠী। সাঁওতাল, হাড়ি, চন্ডাল, ডোমদেরকে এদের উত্তরসুরী ধরে নেওয়া হয়। সুন্দরবন অঞ্চল, যশোরও ময়মনসিংহ জেলায় নেগ্রিটো জনগোষ্ঠীর প্রভাব লক্ষ করা যায়।

২) অস্ট্রিক : নৃতাত্ত্বিকদের মতে অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আসাম হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে অস্ট্রিক জাতি নেগ্রিটোদের উৎখাত করে। তাই বলা হয়ে থাকে বাঙালি জাতির প্রধান অংশ গড়ে ওঠেছে অস্ট্রিক জাতি থেকে এবং তাদেরকে ‘নিষাদ জাতি’ বলা হয়। অস্ট্রিক জাতির কিছু পরে দ্রাবিড় জাতি এদেশে আসে এবং সভ্যতার উন্নতির বলে তারা অস্ট্রিক জাতিকে গ্রাস করে। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণেই সৃষ্টি হয়েছে আর্যপূর্ব বাঙালী জনগোষ্ঠী। আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠীর ভাষা ছিল অস্ট্রিক।

৩) দ্রাবিড় : সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী মূলত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে প্রায় ৪০০০ বছর আগে এদেশে আগমন করে। এরা ভারতের সিন্ধু নদের তীরে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে তোলে। সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কৃত হয় ১৯২১ সালে এবং আবিষ্কারক হলেন- রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। সিলেট জেলায় অধিকাংশ দ্রাবিড় বাস করে।

৪) ভোচীনীয়/মঙ্গোলীয় : এরা তিব্বত অঞ্চল থেকে এদেশে আগমন করে। বাংলাদেশের উপজাতিদের মধ্যে গারো, চাকমা, মনিপুরি, খাসিয়া, হাজং প্রভৃতি মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত।

আর্য জনগোষ্ঠী : আর্য শব্দের অর্থ সদবংশজাত ব্যক্তি। আর্যরা প্রায় ২০০০ বছর আগে ইরান ও রাশিয়ার ইউরাল পর্বতমালা ও ককেশাস পর্বতমালার দক্ষিণে তৃণভূমি অঞ্চল থেকে এদেশে আগমন করে। আর্যরা সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিল। তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম ছিল বেদ। বেদ থেকে ঋগ্বেদের সৃষ্টি হয়েছে।

আর্যদের আদিনিবাস ছিল ইউরাল পর্বতের দক্ষিণে বর্তমান মধ্য এশিয়া ইরানে। সংস্কৃত অর্থে আর্য হলো সৎ বংশ-জাত ব্যক্তি। ভারতর্ষে আর্যদের আগমন ঘটেছিল খ্রিষ্টপর্ব ১৪০০-১৫০০ অব্দে। ভারতবর্ষে আর্যজাতি সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করে সিন্ধু-বিধৌত অঞ্চলে। আর্যরা সনাতনী ধর্মাবলম্বী ছিল, তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম ছিল বেদ। এদেশে আর্যধর্ম বিস্তারের আগে বাংলার ধর্মমত সম্পর্কে সঠিক বিবরণ মিলেনা, আর্য সভ্যতার সংস্পর্শে এদেশে বৈদিক ধর্মের প্রচলন শুরু হয়।

(২) প্রাচীন বাংলার সীমানা : ড. নীহারঞ্জন রায় এর রচিত ‘‌‌‌‌‌বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থে প্রাচীন বাংলার সীমানা সম্পর্কে উল্লেখ করেন-

তাঁর মতে প্রাচীন বাংলার সীমানা ছিল- উত্তরে হিমালয় পর্বত, নেপাল, ভূটান ও সিকিম রাজ্য; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর; পূর্বে জৈন্তা পাহাড়, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণী; পশ্চিমে সাঁওতাল পরগনা, ছোটনাগপুর, কেওঞ্জর, ময়ূরভঞ্জের শৈলময় অরণ্যভূমি; উত্তর-পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদের উপত্যকা এবং উত্তর-পশ্চিমে বিহারের দ্বারভাঙ্গা পর্যন্ত ভাগিরথী নদীর উত্তরে সমান্তরাল এলাকা।

(৩) বাংলার প্রাচীন জনপদ : প্রাচীন যুগে বাংলা (বর্তমানে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) এখানকার বাংলাদেশের মতো কোনো একক ও অখন্ড রাষ্ট্র ছিলনা। বাংলার বিভিন্ন অংশ তখন অনেকগুলো ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। আর প্রতিটি অঞ্চলের শাসক যার যার মত শাসন করতেন। বাংলার এ অঞ্চলগুলোকে তখন সমষ্টিগতভাবে নাম দেয়া হয় ‘জনপদ’। এই জনপদগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো :-

প্রাচীন জনপদরাজধানীবর্তমান বিভাগবর্তমান অবস্থান
পুন্ড্রুপুন্ড্রুবর্ধন→ পুন্ড্রুনগর → মহাস্থানগড়রাজশাহী ও রংপুর।বৃহত্তর বগুড়া (মহাস্থানগড়), রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর (বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন জনপদ এটি)।
গৌড়কর্ণসূবর্ণ, বর্তমান মর্শিদাবাদ জেলার রাঙামাটি গ্রাম।রাজশাহী ও পশ্চিমবঙ্গ (ভারত)মালদ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমানও চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
সমতটবড় কামতা কুমিল্লা শহর থেকে ১২ মাইল পশ্চিমেচট্টগ্রামকুমিল্লা-নোয়াখালী।
হরিকেলনেইসিলেট ও চট্টগ্রামসিলেট ও চট্টগ্রাম।
বঙ্গবঙ্গের রাজধানী ছিলনা, তবে অনেকে বিক্রমপুরকে বঙ্গের রাজধানী বলেছেন।ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা ও বরিশাল। 
বরেন্দ্রনেইরাজশাহী ও রংপুররাজশাহী বিভাগের উত্তর-পশ্চিমাংশ নিয়ে গঠিত। বগুড়ার পশ্চিমাংশ, রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অংশ।
বাকেরগঞ্জ বা চন্দ্রদ্বীপনেইবরিশাল, ঢাকা, খুলনাবরিশাল, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, খুলনা ও বাগেরহাট।
রাঢ়নেইপশ্চিমবঙ্গ (ভারত)ভাগিরথী নদীর পশ্চিম তীরে (পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাংশ বর্ধমান জেলা) এর অবস্থান ছিল। এর অপর নাম সূক্ষ্ম।

 

.(ক) পুন্ড্রু : প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনের দিক থেকে বাংলার সর্বপ্রাচীন জনপদের নাম পুন্ড্রু। পুন্ড্রুদের রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল পুন্ড্রুবর্ধন ® পুন্ড্রুনগর পরে এর নামকরণ করা হয় মহাস্থানগড়। পুন্ড্রু জনপদের বিস্তৃতি ছিল বৃহত্তর বগুড়া (মহাস্থানগড়), রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর। সম্ভবত মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে প্রাচীন পুন্ড্রু রাজ্য তার স্বাধীন সত্ত্বা হারায়। প্রাচীন জনপদ পুন্ড্রের রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে।

.(খ) গৌড় : গৌড়ের রাজধানী ছিল প্রাচীন কর্ণসূবর্ণ, যার বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙ্গামাটি গ্রাম। গৌড় জনপদের বিস্তৃতি ছিল মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

.(গ) সমতট : পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় বঙ্গের প্রতিবেশি জনপদ হিসেবে ছিল সমতটের অবস্থান। এ অঞ্চলটি ছিল আদ্র নিম্নভূমি। বৃহত্তর কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে সমতট গঠিত হয়েছিল। সাত-বারো শতক পর্যন্ত বর্তমান ত্রিপুরা জেলা ছিল সমতটের অন্যতম অংশ। কুমিল্লা শহরের ১২ মাইল পশ্চিমে বড় কামতা নামক স্থানটি সাত শতকে সমতটের রাজধানী ছিল।

.(ঘ) হরিকেল : সাত শতকের লেখকেরা হরিকেল নামে অপর এক জনপদের বর্ণনা করেছেন। চীনা ভ্রমণকারী ইতাসিং বলেছেন- হরিকেল ছিল পূর্ব ভারতের শেষ সীমায়। কারো কারো মতে, চট্টগ্রামও ছিল হরিকেলের অংশ। সকল তথ্য পর্যালোচনা করে ধরে নেওয়া হয় যে- সিলেট ও চট্টগ্রাম পর্যন্ত হরিকেল জনপদ বিস্তৃত ছিল। ৭ম থেকে ১১ শতক পর্যন্ত হরিকেল একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল। কিন্তু পূর্ববাংলার চন্দ্র রাজবংশের রাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্রের চন্দ্রদ্বীপ জনপদ অধিকারের পর হতে হরিকেলকে বঙ্গের অংশ বলে ধরা হয়। হরিকেল জনপদের রাজধানী নেই।

.(ঙ) বঙ্গ : বর্তমান বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বঙ্গ নামে একটি জনপদ গড়ে ওঠেছিল। অনুমান করা হয়, এখানে বঙ্গ নামে এক জাতি বাস করতো। তাই এই জনপদটি পরিচিত হয় বঙ্গ নামে।

একাদশ শতকে পাল বংশের শেষ পর্যায়ে বঙ্গ জনপদ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে উত্তর বঙ্গ ও দক্ষিণ বঙ্গ নামে পরিচিত হয়। পদ্মা ছিল উত্তরাঞ্চলের উত্তরসীমা, দক্ষিণের ব-দ্বীপ অঞ্চল ছিল দক্ষিণ বঙ্গ। পরবর্তীকালে কেশম সেন ও বিশরুপ সেনের আমলেও বঙ্গের দুটি ভাগ পরিলক্ষিত হয়। এদের একটি বিক্রমপুর অপরটি নাব্য অর্থাৎ অধিক নদীমাতৃক অঞ্চল। বঙ্গের কোন রাজধানী ছিলনা। অনেকে বিক্রমপুরকে বঙ্গের রাজধানী বলেছেন। বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, ফরিদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী নিয়ে বঙ্গ গঠিত হয়েছিল। বঙ্গ, সমতট ও হরিকেল এই তিনটি পৃথক জনপদ হলেও এরা খুব নিকট প্রতিবেশি হওয়ায় কখনো কখনো কোনো কোনো এলাকায় অন্য জনপদের প্রভাব বিরাজ করতো বলে ধারণা করা হয়।

.(চ) বরেন্দ্র : বরেন্দ্রী  বা বরেন্দ্র ভূমি নামে প্রাচীন বাংলায় অপরএকটি জনপদের কথা জানা যায়, এটি উত্তরঙ্গের একটি জনপদ। বরেন্দ্র পুন্ড্রুবর্ধন জনপদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপর্ণ এলাকা ছিল। জনপদের প্রধান শহর, মৌর্য ও গুপ্ত আমলে প্রাদেশিক শাসনর্তার কেন্দ্র পুন্ড্রুনগরের অবস্থানও ছিল এই বরেন্দ্র এলাকায়। তাই একে জনপদ বলা যায় না। কিন্তু এ নামে (বরেন্দ্র) এক সময় সমগ্র এলাকা পরিচিত হতো। তাই প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে একে জনপদের মর্যাদা দেওয়া হয়। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, গঙ্গা ও করতোয়া নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে ছিল এ জনপদের অবস্থান। বগুড়া, দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলার অনেকটা অঞ্চল এবং সম্ভবত পাবনা জেলা জুড়ে বরেন্দ্র অঞ্চল বিস্তৃত ছিল।

.(ছ) চন্দ্রদ্বীপ : বর্তমান বরিশাল জেলাই ছিল চন্দ্রদ্বীপের প্রাণকেন্দ্র। এ প্রাচীন জনপদটি বালেশর ও মেঘনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল। এছাড়া বৃহত্তর প্রাচীন বাংলায় দন্ডভুক্তি, উত্তর রাঢ় (বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার পশ্চিমাংশ, সমগ্র বীরভূম জেলা এবং বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহাকমা), দক্ষিণ রাঢ় (র্তমান র্ধমানের দক্ষিনাংশ, হুগলীর বহুলাংশ এবং হাওড়া জেলা)। বাংলা বা বাঙলা (সাধারণত খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালী সুন্দরবন অঞ্চল) ইত্যাদি নামেও শক্তিশালী জনপদ ছিল। এভাবে অতি প্রাচীনকাল হতে ছয়-সাত শতক পর্যন্ত প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। মূলত: ইহা ছিল রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বিভাগ। ৭ম শতকের গোড়ার দিকে শশাংক গৌড়ের রাজা হয়ে মুর্শিদাবাদ হতে উতকল (উত্তর উড়িষ্যা) পর্যন্ত সমগ্র এলাকাকে সংঘবদ্ধ করেন। তারপর হতে বাংলা তিনটি জনপদ নামে পরিচিত হত। এগুলো হলো- পুন্ড্রুবর্ধন, গৌড় ও বঙ্গ। বাকী অন্যান্য জনপদগুলো এ তিনটির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।

বিভক্ত জনপদগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা পালও সেন রাজাদের আমেই অনেকটা পরিপূর্ণতা লাভ করে। শশাংক ও পাল রাজারা সমগ্র পশ্চিম বঙ্গের রাজা হয়েও ‘রাজধিপতি’ বা ‘গৌড়েশর’ বলেই পরিচয় দিতেন। ফলে ‘গৌড়’ নামটি পরিচিত লাভ করে।

.(জ) তাম্রালিপ্ত : হরিকেলের উত্তরে অবস্থিত ছিল এই জনপদের। বর্তমান মেদিনীপুর জেলার তমলুকই ছিল এই জনপদের প্রাণকেন্দ্র। সমুদ্র উপকূলর্তী এ এলাকা ছিল খুব নিচু ও আর্দ্র্য। নৌ-চলাচলের জন্য জায়গাটি ছিল খুব উত্তম। প্রাচীনকালে তাম্রলিপ্ত গুরুত্বপূর্ণ নৌ-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। হুগলী ও রুপনারায়ন নদের সঙ্গমস্থল হতে ১২ মাইল দূরে রুপনারায়ণের তীরে এ বন্দরটি অবস্থিত ছিল। সাত শতক হতে ইহা দন্ডভুক্তি নামে পরিচিত হতে থাকে। আট শতকের পর হতেই তাম্রালিপ্ত বন্দরের সমৃদ্ধি নষ্ট হয়ে যায়।

(৪) প্রাচীন বাংলার রাজধানী ঢাকা : স্বাধীনতার পূর্বে ঢাকা চার বার বাংলার রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। তবে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় মর্যাদা লাভ করে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

.(ক) ১৬১০ : ১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খাঁ কর্তৃক বাংলার রাজধানী বিহারের রাজমহল হতে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয় এবং এর নামকরণ করা হয় ‘জাহাঙ্গীরনগর’।

.(খ) ১৬৬০ : সম্রাট শাহজাহানের ২য় পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ সুজা বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হয়ে ঢাকা হতে রাজধানী বিহারের রাজমহলে স্থানান্তরিত করেন। পরবর্তীতে ১৬৬০ সালে সম্রাট আলমগীর বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হয়ে মীর জুমলা বাংলার রাজধানী রাজমহল হতে ঢাকায় স্থানান্তরিত করেন।

.(গ) ১৯০৫ : মুর্শিদকুলি খান বাংলার নবাব নিযুক্ত হয়ে ১৭১৭ সালে রাজধানী ঢাকা হতে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন। পরবর্তীতে ১৭৯৯ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক নিযুক্ত বাংলার গভর্নর জেনারেল স্যার ওয়েলেসলি বাংলার রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তরিত করেন। লর্ড কার্জন বঙ্গবিভাগ সম্পন্ন করলে নবগঠিত প্রদেশ ‘পূর্ববঙ্গ ও আসামের’ রাজধানী ঢাকা মর্যাদা লাভ করে।

.(ঘ) ১৯৪৭ : পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে।

.(ঙ) ১৯৭২ : ১৯৭২ সালে ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে।

(৫) প্রাচীন বাংলায় বিভিন্ন পরিব্রাজকের আগমন :

.(ক) মেগাস্তিনিস : খ্রিস্টপূর্ব ৩০২ অব্দে মেগাস্তিনিস নামক একজন গ্রীক দূত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পাটালিপুত্রে প্রেরিত হন। তৎকালীন সময়ে প্রাচীন বাংলার শাসক ছিলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। মেগাস্তিনিসের ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে ভারতবর্ষের তৎকালীন পরিস্থিতির বিবরণ দেন।

.(খ) ফা-হিয়েন : গুপ্তযুগে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন বৌদ্ধ ধর্মের মূল গ্রন্থের সন্ধানে ও তীর্থ দর্শনে ভারতবর্ষে আসেন। তিনি ৪০১-৪১০ খ্রি. পর্যন্ত ভারতবর্ষে অবস্থান করেন। তিনিই সর্বপ্রথম বাংলার প্রথম চৈনিক পরিভ্রাজক।

.(গ) হিউয়েন সাং : চীন দেশীয় বৌদ্ধ পন্ডিত হিউয়েন সাং সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে প্রাচীন বাংলায় আসেন। তিনি ৬৩০-৬৪৪ খ্রি. পর্যন্ত প্রাচীন বাংলায় অবস্থান করেন। তিনি হর্ষবর্ধনের রাজধানী পাটুলিপুত্রের দক্ষিণে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর অধ্যয়ন ও পুঁথি নকল করেন। বাঙ্গালী পন্ডিত শীল ভদ্র ছিলেন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। এটি ছিল তৎকালে বৌদ্ধদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্র।

(৬) প্রাচীন বাংলায় বিভিন্ন শাসনামল :

.(ক) আলেকজান্ডার এর শাসন : খ্রিষ্টপর্ব ৩২৭ অব্দে আরেকজান্ডার তার সেনাপতি সেলুকাসের নেতৃত্বে ভারতবর্ষে আক্রমন করেন। আলেকজান্ডার জাতিতে ছিলেন আর্য গ্রিক। তিনি ছিলেন ম্যাডিসনের রাজা ফিলিপসের পুত্র। বাল্যকালে তিনি গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের নিকট গৃহশিক্ষা লাভ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৫ অব্দে তার পিতা ফিলিপসের মৃত্যু হলে তিনি ম্যাডিসনের সিংহাসন আরোহন করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৫ অব্দে ব্যাবিলনে আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয়।

.(খ) মৌর্য শাসন : ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সাম্রাজ্যের নাম মৌর্য সাম্রাজ্য। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য খ্রিঃ পূর্ব ৩২১ অব্দে মগদের সিংহাসনে আরোহণের মাধ্যমে ভারতে মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন ভারতে প্রথম সম্রাট। পটলিপুত্র ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানী। চাণক্য ছিলেন মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী। চাণক্যের ছদ্মনাম কৌটিল্য। চাণক্যের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’ একটি সংস্কৃত গ্রন্থ। এটি রাষ্ট্রশাসন ও কূটনীতি কৌশলের সার সংক্ষেপ।

.(গ) সম্রাট অশোক : মৌর্য বংশের তৃতীয় সম্রাট ছিলেন অশোক। তিনি বিন্দুসারের মৃত্যুর পুর মৌর্য সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। বিন্দুসার ছিলেন অশোকের পিতা। উত্তর বাংলায় মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে। অঞ্চলটি মৌর্যদের একটি প্রদেশে পরিণত হয়েছিল। প্রাচীন পুন্ড্রুনগর ছিল এ প্রদেশের রাজধানী। মহাস্থানগড়ে সম্রাট অশোকের একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। কলিঙ্গের যুদ্ধ খ্রি: ২৬০/২৬১ অব্দে সম্রাট অশোকের জীবনে ছিল এক মাইলস্টোন। যুদ্ধে কলিঙ্গ রাজ সম্পূর্ণ পরাজিত হন এবং এক লক্ষ লোক নিহত হন। যুদ্ধের ভয়াবহ এই পরিণাম প্রত্যক্ষ করে মহারাজ অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর শাসনামলে বৌদ্ধধর্ম বিশ্বর্মের মর্যাদা পায়। এজন্য তাকে বৌদ্ধর্মের কনস্ট্যানটাইন (অপরিবর্তণীয়/ ধ্রুবক) বলা হয়।

.(ঘ) গুপ্ত শাসন : গুপ্তযুগকে প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এ যুগে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শিল্পের খুবই উন্নতি হয়। ভারতে গুপ্তবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। তিনি ৩২০ সালে পাটালিপুত্রের সিংহাসনে আরোহন করেন।

চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর সমুদ্রগুপ্ত পাটালিপুত্রের (পাটনা) সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন গুপ্তবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। তাঁকে প্রাচীন ভারতের ‘নেপোলিয়ান’ বলা হয়। তাঁর আমলে সমতট ছাড়া বাংলার অন্যান্য জনপদ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। গুপ্ত অধিকৃত বাংলার রাজধানীও ছিল পুন্ড্রুনগর। সমুদ্রগুপ্ত এর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পাটালিপুত্রের সিংহাসনে বসেন। তিনি মালবের উজ্জয়িনীতে সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন। বিক্রমাদিত্যে ছিল তাঁর উপাধি। তাঁর সভায় কালিদাস, বিশাক দত্ত, নাগার্জুন, আর্যদেব, সিদ্ধসেন, দিবাকর প্রমুখ কবি সাহিত্যিকের সমাবেশ ঘটে।

গুপ্তযুগে আর্যভট্ট এবং বরাহমিতহর ছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী। আর্যভট্ট অন্যসবার আগে পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতি নির্ণয় করেন। আর্যভট্টের গ্রন্থের নাম ‘আর্য সিদ্ধান্ত’। ববাহ মিহির ছিলেন একজন জ্যোতির্বিদ। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘বৃহৎ সংহিতা’। ৬ষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ যাযাবর জাতি হুনদের আক্রমণে টুকরো টুকরো হয়ে যায় গুপ্ত সাম্রাজ্য। গুপ্তবংশের পতনের পর বাংলায় দুটি স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয়। যথা : বঙ্গ রাজ্য ও গৌড় রাজ্য।

.(ঙ) গুপ্ত পরবর্তী যুগ : গুপ্ত বংশের পতনের পর বাংলায় দু’টি স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয়। যথা- বঙ্গ রাজ্য ও গৌড় রাজ্য।

) স্বাধীন বঙ্গ রাজ্য : প্রাচীনকালে রাজারা তামার পাত্রে খোদাই করে বিভিন্ন ঘোষণা বা নির্দেশ দিতেন এগুলোকে তাম্র শাসন বলা হতো। স্বাধীন বঙ্গ রাজ্যে এরকম ০৭টি তাম্রলিপি পাওয়া গেছে।

) স্বাধীন গৌড় রাজ্য : গুপ্ত রাজাদের অধীনে বড় কোন অঞ্চলের শাসনকর্তাকে বলা হত ‘মহাসামন্ত’। শশাংক ছিলেন গুপ্তরাজা মহাসেন গু্প্তের একজন ‘মহাসামন্ত’ এবং পরবর্তীতে তিনি প্রাচীন বাংলার জনপদগুলোকে গৌড় নামে একত্রিত করেন এবং ৬০৬ সালে তিনি গৌড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ও স্বাধীন গৌড় রাজ্যের সম্রাট হন। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা এবং তিনি গৌড়ের রাজধানী স্থাপন করেন কর্ণসুবর্ণে যা বর্তমানে মুর্শিদাবাদের রাঙ্গামাটি গ্রাম। শশাংকের উপাধি ছিল ‘রাজাধিরাজ’। তিনি ৬১৯ পর্যন্ত প্রবল প্রতাবের সাথে ভারত শাসন করেন।

) হর্ষবর্ধন : ৬০৬ সালে হর্ষবর্ধন সিংহাসনে আরোহন করেন। চীনা পরিভ্রাজক হিউয়েন সাং তার রাজত্বকালে ৬৩০-৬৪৪ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষ সফর করেন।

.(চ) পাল শাসন :

(ক) মাৎস্যন্যায় : পুকুরে বড় মাছগুলো শক্তির দাপটে ছোট ছোট মাছ ধরে ধরে খেয়ে ফেলার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে বলে ‘মাৎস্যন্যায়’। শশাংকের মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন বাংলায় কোন যোগ্য শাসক ছিলনা। সামন্ত রাজারা প্রত্যেকেই বাংলার রাজা হওয়ার কল্পনায় অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে থাকেন। বাংলার সবল অধিপতিরা এমনি করে ছোট ছোট অঞ্চলগুলোকে গ্রাস করেছিল। এ অরাজকপূর্ণ সময় (৭ম-৮ম শতক) কে পাল তাম্র শাসনে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলে।

(খ) পাল শাসন : বাংলার দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশ হচ্ছে পাল বংশ। পাল বংশের রাজারা প্রায় চারশত বছর (৭৫০-১১২৪) বাংলায় রাজত্ব করেন। পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গোপাল পাল (৭৫০ সালে) এবং তিনি পাল বংশের প্রথম রাজা ছিলেন। বাংলায় প্রথম বংশানুক্রমিক শাসন শুরু হয় পাল বংশের রাজত্বকালে। পাল বংশের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। পাল রাজাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন গোপালের পুত্র ধর্মপাল। তিনি সোমপুর বিহার প্রতিষ্ঠা করেন যা নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরে অবস্থিত। ধর্মপাল ধর্ম বিস্তারের জন্য ৫০টি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন। পাল বংশের সর্বশেষ রাজা ছিলেন রামপাল (১০৮২-১১২৪)। পাল শাসনামলে রচিত ‘রামচরিতম’ গ্রন্থ থেকে রামপালের রাজত্ব সম্পর্কে জানা যায়। বরেন্দ্র এলাকায় পানিকষ্ট দূর করার জন্য তিনি অনেক দীঘি খনন করেন। দিনাপজপুর শহরের নিকট যে ‘রামসাগর’ রয়েছে তা রামপালের কীর্তি। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ পাল বংশ এর সময়ে রচিত হয়।

.(ছ) সেন শাসন : বাংলায় সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সামন্ত সেন। তিনি কর্ণাট থেকে বৃদ্ধ বয়সে বাংলায় আসেন। তিনি প্রথমে বসতি স্থাপন করেন রাঢ় অঞ্চলে গঙ্গা নদীর তীরে। তিনি রাজ্য প্রতিষ্ঠা না করায় সে বংশের প্রথম রাজার মর্যাদা দেওয়া হয় সামন্ত সেনের পুত্র হেমন্ত সেনকে। সেন রাজাদের ধর্ম ছিল হিন্দু। সেন বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন বিজয়সেন। তাকে সেন বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তার রাজত্বকাল ছিল ১০৯৮-১১৬০ খ্রি: পর্যন্ত। বিজয় সেনের উপাধি ছিল পরমেশ্বর ® পরমভট্টারক ® মহারাজাধিরাজ।

বল্লাল সেন ছিলেন বিজয় সেনের পুত্র। তিনিও ছিলেন সেন সম্রাট (রাজত্বকাল ১১৬০-১১৭৮ খ্রি: পর্যন্ত)। বল্লাল সেন বাংলায় সামাজিক সংস্কার বিশেষ করে কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তনকারী হিসেবে পরিচিত। বল্লাল সেনের উল্লেখযোগ্য রচনাবলী দানসাগর ও অদ্ভূত সাগর।

বাংলার শেষ হিন্দু রাজা ছিলেন সেন বংশের সম্রাট লক্ষণ সেন। তার শাসনামল ছিল ১১৭৮-১২০৬ খ্রি: পর্যন্ত। লক্ষণ সেনের রাজধানী ছিল গৌড় ও নদীয়াতে। ১২০৪ সালে মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে নদীয়া দখল করেন। লক্ষণ সেনের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় সেন বংশের হিন্দু রাজাদের শাসনের অবসান ঘটে। পরবর্তীতে শুরু হয় বাংলার ইতিহাসের মধ্যযুগ।

(৭) বিভিন্ন শাসনামলে বাংলার রাজধানী :

ক্রমিক নংশাসনামলরাজধানী
০১প্রাচীন বাংলামহাস্থানগড়
০২সুলতানী আমলসোনারগাঁও (১৩৩৮-১৩৫২ খ্রি.) গৌড় (১৪৫০-১৫৬৫ খ্রি.)
০৩মুঘল আমলসোনারগাও
০৪মৌর্যও গুপ্ত যুগেগৌড়
০৫শশাংকের সময়কর্ণসুবর্ণ
০৬হর্ষবর্ধনকনৌজ
০৭ঈসা খানসোনারগাঁও
০৮লক্ষণসেননদীয়া
০৯বর্মদেববিক্রমপুর
১০গুপ্ত রাজ বংশবিদিশা

 

(৮) প্রাচীন বাংলা সম্পর্কে চীনা পর্যটকদের রচিত গ্রন্থ :

ক্রমিক নংগ্রন্থের নামগ্রন্থের রচয়িতা
০১.ফো-কুয়ো-কিংফা-হিয়েন
০২.সি-ইউ-কিহিউয়েন সাং
০৩.সিকিসোমা তিয়েন
০৪.সিয়েন-হান-শুপ্যান-কু
০৫.হৌ-হান-শুফ্যান-ই

 

(৯) কতিপয় প্রাচীন গ্রন্থ ও গ্রন্থের প্রণেতা :

ক্রমিক নংগ্রন্থের নামগ্রন্থের রচয়িতা
০১.বেদঈশ্বর
০২.মহাভারতবেদব্যাস
০৩.রামায়ন (সংস্কৃত)বাল্মিকি
০৪.বিদ্যাসুন্দরশ্রীধর
০৫.রিয়াজ-উস-সালাতিনগোলাম হোসেন সলিম
০৬.রামায়ন (বাংলা)কৃত্তিবাস
০৭.অর্থ শাস্ত্রকৌটিল্য
০৮.রামচরিতমসন্ধাকর নন্দী
০৯.বৃহৎসংহিতাবরাহ মিহির
১০.মেঘদূতকালিদাস

 

উপরোক্ত আলোচনার আলোকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নাবালি :

০১।   বাংলা ভাষা কোন ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত- ইন্দো-ইউরোপীয়।

০২।  ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার কয়টি শাখা ছিল- ০২টি; কেন্তম ও শতম।

০৩।  যে গোষ্ঠী থেকে বাঙালী জাতির প্রধান অংশ গড়ে উঠেছিল- অস্ট্রিক।

০৪।   আর্য-পূর্ব বা অনার্য জনগোষ্ঠী মূলত কয়টি ছিল- ০৪টি (নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, ভোটচীনীয়/মঙ্গোলীয়)।

০৫।  আর্যদের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল- ইউরাল পর্বতের দক্ষিণে তৃণভূমি অঞ্চলে।

০৬।  গারো, চাকাম, মনিপুরী উপজাতিদের পূর্বপুরুষ- ভোটচীনীয়/মঙ্গোলীয়।

০৭।   সিন্ধু সভ্যতা কে আবিষ্কার করেন- রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২১)।

০৮।  অস্ট্রিক জাতিকে বলা হয়- নিষাদ জাতি।

০৯।  বাঙালীর ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা কে- ড. নীহারঞ্জন রায়।

১০।   বঙ্গ দেশের সীমানা নির্দেশ করেছেন- ড. নীহারঞ্জন রায় ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে।

১১।   বাংলা (দেশ ও ভাষা) নামের উৎপত্তির বিষয়টি কোন গ্রন্থে সর্বাধিক উল্লিখিত হয়েছে- আইন-ই-আকবরী।

১২।   বাংলার প্রাচীন জনপদের সংখ্যা কয়টি- ১৬টি (বাংলায় ছিল ১০টি)।

১৩।  প্রাচীন বাংলার জনপদের ভাষা- অস্ট্রিক।

১৪।   সর্বপ্রাচীন জনপদ- পুন্ড্রু।

১৫।   বঙ্গ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়- ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থে।

১৬।  ঢাকা অবস্থিত ছিল- বঙ্গ জনপদে।

১৭।   প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস গ্রন্থ কোনটি- রাজ তরঙ্গিনী।

১৮।  রাজ তরঙ্গিনী গ্রন্থের রচয়িতা কে- কলহন।

১৯।   বাংলা শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন- আবুল ফজল।

২০।  বাংলা শব্দটি এসেছে- বঙ্গ+আইল/আল শব্দ হতে।

২১।   শীলা দেবীর ঘাট অবস্থিত- বগুড়ায়।

২২।  মহাস্থানগড়ের পুরাতন নাম- পুন্ড্রুবর্ধন।

২৩।  সমতট বর্তমান যে অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল- কুমিল্লা-নোয়াখালী।

২৪।   বরিশালের পূর্বনাম ছিল- বাকেরগঞ্জ ও চন্দ্রদ্বীপ।

২৫।  বাংলার কোন প্রাচীন জনপদটি সূক্ষ্ম নামে পরিচিত ছিল- রাঢ়।

২৬।  মহাস্থানগড় কোন নদীর তীরে অবস্থিত- করতোয়া।

২৭।   চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রাচীন নাম- হরিকেল।

২৮।  প্রাচীন সমতট জনপদের রাজধানী ছিল- বড় কামতা।

২৯।  ঢাকায় সর্বপ্রথম রাজধানী হয় কত সালে- ১৬১০ সালে।

৩০।  কে সর্বপ্রথম রাজমহল হতে বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন- সুবেদান ইসলাম খাঁন।

৩১।  স্বাধীনতার পূর্বে ঢাকা কতবার বাংলার রাজধানী হিসেবে মর্যাদা লাভ করে- ০৪ বার (১৬১০, ১৬৬০, ১৯০৫ ও ১৯৪৭ সালে)।

৩২।  চীনা পরিভ্রাজক হিউয়েন সাং এর দীক্ষাগুরু কে ছিলেন- শীল ভদ্র।

৩৩।  শীল ভদ্র কোন মহাবিহারের আচার্য ছিলেন- নালন্দা বিহার।

৩৪।  মেগাস্তিনিস কার রাজসভার গ্রীক দূত ছিলেন- চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

৩৫।  মেগাস্তিনিস কোন দেশীয় পরিভ্রাজক ছিলেন- গ্রীক বা গ্রীস।

৩৬।  বাংলায় প্রথম পরিভ্রাজক কে- ফা-হিয়েন, চৈনিক পরিভ্রাজক।

৩৭।  আলেকজান্ডারের সেনাপতি হলেন- সেলুকাস।

৩৮।  মহাবীর আলেকজান্ডার কোন শহরে মৃত্যুবরণ করেন- ব্যাবীলন।

৩৯।  আলেকজান্ডারের শিক্ষক ছিলেন- এরিষ্টটল।

৪০।   কোন জনগোষ্ঠী থেকে মৌর্য কথাটি এসেছে- মোরিয়া।

৪১।   মৌর্যযুগে গুপ্তচরকে যে নামে ডাকা হতো- সঞ্চারা।

৪২।   মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন- চানক্য।

৪৩।  অর্থ শাস্ত্র বিখ্যাত গ্রন্থের রচয়িতা- কৌটিল্য।

৪৪।   বৌদ্ধ ধর্মের কনস্ট্যান্টাইন বলা হয়- সম্রাট অশোককে।

৪৫।   ভারতের নেপোলিয়ান হিসেবে অভিহিত ছিলেন- সমুদ্র গুপ্ত।

৪৬।  বাংলার প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা ছিলেন- শশাংক।

৪৭।   শশাংকের উপাধি ছিল- মহাসামন্ত।

৪৮।  গৌড়ের রাজধানীর নাম ছিল- কর্ণসুবর্ণ।

৪৯।   চীনা বৌদ্ধ পন্ডিত হিউয়েন সাং ভারতে আসেন- হর্ষবর্ধনের আমলে।

৫০।  গুপ্ত সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়- হুন শক্তির হাতে।

৫১।   মাৎস্যন্যায়ের ব্যাপ্তীকাল- ৭ম-৮ম শতক।

৫২।  পাল রাজারা যে ধর্মাবলম্বী ছিলেন- বৌদ্ধ।

৫৩।  পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা- গোপাল।

৫৪।   সোমপুর বিহার নির্মাণ করেন- রাজা ধর্মপাল।

৫৫।  পাল বংশের শেষ রাজা- রামপাল।

৫৬।  রামসাগর- রামপালের কীর্তি।

৫৭।   রামপালের রাজত্ব সম্পর্কে যে গ্রন্থে জানা যায়- রামচরিতম।

৫৮।  সেন বংশের প্রথম রাজা বা প্রতিষ্ঠাতা- হেমন্ত সেন।

৫৯।  সেন বংশের সর্বপ্রথম স্বাধীন রাজা- বিজয় সেন।

৬০।  সেন বংশের রাজা বল্লাল সেনের উল্লেখযোগ্য রচনাবলি- দান সাগর ও অদ্ভূত সাগর।

৬১।  কৌলিন্য প্রথার (জাতিভেদ প্রথা) প্রবর্তক ও ঢাকেশ্বরী মন্দির নির্মাণ করেন- বল্লাল সেন।

৬২।  সেন বংশ ও বাংলার সর্বশেষ হিন্দু রাজা- লক্ষণ সেন।

৬৩।  হর্ষবর্ধনের সময় বাংলার রাজধানী ছিল- কনৌজ।

৬৪।  লক্ষণ সেনের সময় বাংলার রাজধানী ছিল- নদীয়া।

৬৫।  গুপ্ত রাজ বংশের সময় বাংলার রাজধানী ছিল- বিদিশা।

 

বুক রেফারেন্স :

০১। বাঙ্গালীর ইতিহাস- ড. নীহারঞ্জন রায়।

০২। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- ড. মাহাবুবুবল আলম।

০৩। সামাজিক ইতিহাস ও বিশ্ব সভ্যতা- ড. দেলোয়ার হোসেন।

০৪। ইতিহাস ১ম ও ২য় পত্র- উচ্চ মাধ্যমিক।

০৫। বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্ব সভ্যতা- ৯ম-১০ম।

০৬। বিভিন্ন জার্নাল ও ইন্টারনেট।